নারীর অধিকার বলতে পুরুষরা আসলে কি বোঝে এই নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। নারীবাদ নিয়ে যারা লেখেন তারা আসলে নারীবাদকে কতটুকু সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন সেখানেও আমি সন্দিহান। অনেক পুরুষরা ভাবেন মেয়েদেরকে কথা বলতে দিলেই মনে হয় নারীকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়ে ফেলেছেন। আবার অনেকে ভাবেন নারীকে কথা বলতে দিলেই নারীকে অধকার দেয়া হচ্ছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা বা নারীর পাওনা অধিকার নিয়ে কথা বললে কিছু পুরুষ পছন্দ করেন না। পাঁচ বছরের অবুঝ শিশুর মতো তাদের মনে হয় মাকে এক কামড় আইসক্রিম দিলে তার ভাগে কম পড়ে যাবে। তাদের মনে হয় নারীদের নিয়ে অনেক কথা হয়ে যাচ্ছে, তাই তারা নারী দিবসে পুরুষদের শত দুঃখের বয়ান শুরু করেন। পুরুষরাও তো নির্যাতিত হয়, সব পুরুষ খারাপ নয়, নারী দিবস কেন, “মানুষ” দিবস নয় কেন ইত্যাদি আরোও কত কী।
তখন তাদের বুঝিয়ে বলতে হয় যে, না সোনা, ভাগাভাগি করে খেতে হয়। মায়ের সাথে আইসক্রিম ভাগ করে খেলে সবাই তোমাকে ভালো বলবে। তাদের বুঝিয়ে বলতে হয় নারীবাদীরা তাদের ভাতে মারতে চান এমন না, তারা কেবল পুরুষের সমান ভাত চান। বুঝিয়ে বলতে হয় কীভাবে পুরুষ নিজেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভুক্তভোগী, সমতা প্রতিষ্ঠিত হলে তারাও কী কী পাবেন সেই ফর্দ দিতে হয়।
কেন? এমনি এমনি মানবিক হওয়া যায় না? ধরেন নিজের মা-বোনের গায়ে কেউ হাত দিলে কেমন লাগবে সেই হিসাব না করেই আপনি রাস্তায় মেয়েদের গায়ে হাত দিলেন না। ধরেন আপনাকে কেউ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা বললো না, তবু আপনি সন্তানকে একটু সময় দিলেন। ধরেন আপনাকে কেউ মুক্তমনা বললো না, তবু আপনি স্ত্রীকে চাকরি করতে দিয়ে তার জীবন ধন্য করলেন। ধরেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আপনাকে শুধুই সুবিধা দিচ্ছে, তবু আপনি “সব পুরুষই তো খারাপ না” কথাটা না বলে একজন নিপীড়িত নারীর প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করলেন। ধরেন পরকালে কোনো হুরপরী থাকবে না, তবু আপনি একজন সুস্থ মানুষের মতো আচরণ করলেন।
ধরেন আমরা সবাই প্রতিদান পাবার আশা না করেই স্বাভাবিক মানুষ, এমনকি ভালো মানুষ হলাম। পথে, ঘাটে, বাসে, রিকশায়, ট্রেনে, জীবনে লজ্জিত, অপমানিত, অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত হবার ভয়ে ছোট্ট হয়ে থাকা নারীদের পাশে ধরেন আমরা এমনিই দাঁড়ালাম।
পুরুষরাও নির্যাতিত হন। কিন্তু এই প্রসঙ্গ কেবল তখনই ওঠে যখন নারীদের অধিকারের আলাপ হয়। কেননা নারীর অধিকার নিয়ে যখন আলাপ হয়, অন্য যেকোনো প্রসঙ্গই তখন সমাজে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষের প্রতি সহিংসতা বা অবিচার নিয়ে যদি সত্যিই পুরুষ চিন্তিত হতেন, তবে কেবল নারী দিবসে তাদের সেকথা মনে পড়তো না। তাদের চিন্তা মূলত নারীর প্রতিবাদকে অকৃতকার্য করা। সকল পুরুষ খারাপ নন। কিন্তু সকল নারীই কোনো না কোনো পর্যায়ের সহিংসতার শিকার। দশটি আইসক্রিমের একটি বিষাক্ত হলে দশটিকেই আমরা সন্দেহ করবো না কি? একজন পুরুষের “ভালো” হতে বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না, ধর্ষক না হলেই বলা যায় ‘বাহ, ভালো ছেলে!’ যেখানে একজন নারীর খারাপ হতে ওড়না না পরার স্পর্ধাই যথেষ্ট। ধর্ষণ না করাই যে একজন সভ্য মানুষের স্বভাব হওয়া উচিত, ধর্ষণ করেননি বলে তাকে যে কোনো পদক দিতে হবে না, সেটা পুরুষ তো ভুলে যানই, নারীরাও মনে রাখতে পারেন না। সসম্মানে জানমাল সহকারে বাড়ি ফিরতে পারাটাই আজকাল একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা। নারী দিবসকে ‘মানুষ দিবস’ বলা হয়না কারণ নারীকে যদি মানুষ মনে করাই হতো তবে কেবল এতটুকু নিরাপত্তার জন্য এতো জবাবদিহি করতে হতো না।
নারীকে দয়া করলে প্রতিদানে তিনি কী পাবেন, তাই যদি একজন পুরুষের অমানুষ না হবার একমাত্র কারণ হয়, তবে তিনি স্বয়ংই সমস্যা। মেয়েসন্তানকে যখন আমরা পুরুষের হাত থেকে বাঁচবার বিবিধ কৌশল শেখাই, ছেলেসন্তানকে তখন শেখানো উচিত নারীর প্রতি নিঃস্বার্থ সম্মান প্রদর্শন হওয়া উচিত তার স্বভাব। মেয়েসন্তানকে যখন হিংস্র পুরুষের কথা জানান, ছেলেসন্তানকে তখনই শেখান সভ্যতা কী। নারীর অধিকার কোনো বিতর্কের বিষয় নয়, নারীর অধিকার নারীর অধিকার।
এই লেখার মাধ্যমে বিষয়টা বোঝানর চেষ্টা করেছি। তার পর ও যদি পুরুষরা ভাবেন আপনারা যা করছেন এভাবেই নারীদেরকে সম্মান দিচ্ছেন তাহলে আপনারা এখনও গাধাই রয়ে গেলেন। নিজের ইগোর কারনে সত্যতা থেকে এখনো অনেক দুরে আপনি। নারীকে সত্যিকার অর্থে যে পুরুষ বুঝতে পারেন সেই গুটিকয়েকের দলে আপনি পরেন না।