নারীবাদ মানে পুরুষবিদ্বেষী নয়

নারীদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই ইচ্ছাশক্তি আর আত্মসম্মানবোধের। নিজের মুক্তির চাবি নিজের হাতেই রাখা ভালো। নিজের জীবনের চালনা শক্তি যখন পুরুষদের হাতে দেবেন এবং নিজের সবকিছুর মালিক যখন একজন পুরুষ বা একজন পুরুষের কোথায় ওঠা বসা করা একজন নারীর হাতে দেবেন সেখানেই আপনি পরাধীনতার শেকলে বেধেছেন। বাধন খোলা খুব সহজ যদি আপনি আপনার কম্ফরট জোন থেকে বের হন।

যারা ভাবেন যে, নারীবাদ মানেই “পুরুষ বিদ্বেষ”, প্রথমত এটা ভুল ধারণা, দ্বিতীয়ত, যারা এটা প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে নারীরা পুরুষ বিদ্বেষী, তারা আসলে তাদের অস্তিত্ব বা স্বকীয়তা হারানোর ভয়ে থাকে।

একটা মেয়ে যখন তার যোগ্যতা দিয়ে উন্নতি করতে থাকে সেটা বেশিরভাগ পুরুষেরই চক্ষুশূল হয়ে যায়। কেন হয় চক্ষুশূল?? কারণ একটা ছেলে শিশুকে জন্মের পর থেকেই শেখানো হয় “তুমি পুরুষ, তাই তুমি রাজা” তুমি সিংহাসনে বসবে আর তোমার পাশে বসবে সুন্দরী রানী, যাকে তুমি যা বলবে তাই শুনতে এবং করতে বাধ্য। সে শুধুমাত্র তোমার সিংহাসনের সৌন্দর্য বর্ধন করবে। তার মানে ওই সিংহাসনে যেই বসবে, রানী তারই সৌন্দর্য বর্ধন করবে। এই ধারণার জন্য কিন্তু শুধুমাত্র পুরুষরাই দায়ী, তা কিন্তু নয়। অনেকে নারী বা মেয়েরাও অনেকাংশে দায়ী। অনেক মেয়েই পরজীবী থাকতে ভালোবাসে।

এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মেয়েদের অবস্থার খুব উন্নতি হয়েছে তা নয়। এখনও একটা মেয়েকে তার ইচ্ছানুসারে কোন কিছু করার অনুমতি মিলে না, শুনতে হয় “বিয়ের পরে” যা ইচ্ছা করিস!! আর বিয়ের পর কী হয় সে আর বলার বাকি রাখে না। সংসার সন্তান আর দায়িত্বের চাপে মেয়ে নিজেকেই খুঁজে পায় না। এখনো ভাবা হয় একটা মেয়ের যদি ভালো ফ্যামিলিতে বিয়ে বা ওয়েল সেটেল্ড ছেলের সাথে বিয়ে হয়, তাহলে তার লাইফ সেট।

এই “ভালো” র সংজ্ঞা আমি জানি না! মেয়েকে ওয়েল সেটেল্ড করার চিন্তা করে না। আর ঘুরেফিরে সেই একজন পুরুষের অধীনে থাকাটাই হচ্ছে একজন নারীর তথাকথিত মুক্তি! অনেকটা শিকলের মতো। পায়ে শিকল বেঁধে ছেড়ে দেয়া আর বলা “তুমি তোমার ইচ্ছামতো উড়তে থাকো” তবে এসব বিষয় থেকে বের হতে শুরু করেছে। তবে কেবলমাত্র শহরের কিছু মেয়েরা! গ্রামে-গঞ্জে এখনও অধিকাংশ মেয়ের দশা সেই রান্নাঘরের চৌকাঠ পর্যন্তই। এখন কিছু মানুষ বলবে, ‘রান্না করা কি অসম্মানজনক কাজ”? না, রান্না করা বা সংসারের দায়িত্ব নেয়া কোনভাবেই অসম্মানজনক কাজ নয়। বরং সম্মানেরই। কিন্তু অসম্মানজনক হচ্ছে সংসারের গুরুদায়িত্ব যে পালন করছে তাকে সম্মান না দেয়া। অসম্মান কীভাবে হচ্ছে? খুবই পরিচিত উক্তি “ও কিছু করে না, ঘরে থাকে”। আর যে সব নারী সংসার সামলানোর পাশাপাশি চাকরি করেন, তাদের তো ঘরে বাইরে দুই জায়গায় কথা শুনতে হয়। আমার জীবনে শোনা খুব হাস্যকরউক্তি “লক্ষ্মী আর স্বরসতী একসাথে থাকে না”।

কিছুদিন আগে আমাকে একজন চিৎকার করে ডেকে বলেছিলেন, “নামাজের সময় আপনারা নিচে নামবেন না, আমাদের ছেলেদের অজু নষ্ট হয়”। কারণ ওনার ছেলেরা মেয়েদের তেঁতুল মনে করে, দেখলেই জিভে জল চলে আসে। দোষ সব তেঁতুলের, যে তার নিজের জিভের পানি কন্ট্রোল করতে পারে না তার কোন দোষ নেই। যেদি ওনার ছেলেরা তাদের জিভের পানি কন্ট্রোল করতে পারবে সেদিন আশা করি নারীমুক্তি সম্ভব, এর আগে নয়। প্রত্যেকটা মেয়েই মানুষ। আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো দুঃখ-কষ্ট আছে। বিশ্বাস করেন, মেয়েরাও কষ্ট পায়, ভেঙ্গেচুরে যায়, ক্ষতবিক্ষত হয়, হাসি আনন্দে মেতে উঠে, খুশি হয়, জ্বর হয়, কান্সার হয়, সেক্স আছে, ভালো খারাপ বোধ আছে। এরা পুতুল না। রক্তে মাংসে মানুষ। হাত কাটলে এদেরও রক্ত বের হয়।

যেদিন প্রতিটা পুরুষ মেয়েদের “মেয়ে” ভাবার আগে “মানুষ” ভাববে, সেদিন প্রতিটা নারী নিজেদের “মানুষ” ভাববে, সেদিন নারীমুক্তি সম্ভব। আর সেদিন নারীদের কোন চাওয়াকে নারীবাদী মনে হবে না।

নারীর চাওয়াকে নিজের চাওয়ার সাথে মিলিয়ে দেখুন দেখবেন বিষয়টা স্বাভাবিক। আপনাকে যদি বলা হয় আপনি এই পোশাক পড়তে পারবেন না, এটা খেতে পারবেন না, এখন বাইরে যেতে পারবেন না, বন্ধুদের সাথে সন্ধ্যায় আড্ডা দেয়া যাবে না, বা রাতে লঙ ড্রাইভ যাওয়া যাবে না। মোটকথা আপনার সকল স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে নেয়া হল এবং বলা হল  শুধু ঘর সামলাবেন আর বাচ্চা জন্ম দেবেন । একবার ভাবুনতো! কেমন লাগবে আপনার?