লড়াইটা শুধু পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, এই লড়াই মানসিকতার বিরুদ্ধে

সমতার অধিকারে আমরা পুরুষদের থেকে অনেক পিছনে। আমাদের লড়াইটা শুধু পুরুষদের বিরুদ্ধে নয় ওদের মানসিকতার বিরুদ্ধে। আর ওই সকল নারীদের বিরুদ্ধে যেখানে পুরুষদের এই মানসিকতার সমর্থন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। সেই সকল নির্লজ্জ, অসৎ নারীদের বিরুদ্ধে যে কোনদিন নারী স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে নি। যে সমাজ ব্যাবস্থার দোহাই দিয়ে এই অনাচার করে আসছে যুগ যুগ ধরে।

নারী-পুরুষের বৈষম্যের শুরুটা এখনকার নয়– সৃষ্টির শুরু থেকেই। পুরুষ তার সুঠাম দেহবল্লবকে সর্বদা যোগ্যতার হাতিয়ার হিসেবে মনে করত। দুর্বল শারীরিক শক্তি সম্পন্ন নারীকে গণ্য করা হতো ভোগবিলাসের পণ্য হিসেবে। নারীর যোগ্যতা, মেধা, প্রজ্ঞা, সবকিছুই তখন অন্তঃপুর নামক চার দেয়ালে বন্দি করে রাখা হতো। নারীরা সেসময় থেকেই এ দেয়াল ভাঙ্গার সংগ্রামে লিপ্ত। চলছে আজও সেই সংগ্রাম।

নারীকে হেয় করে, নারীরকে অবদমিত করে, নারীর অবদানকে অস্বীকার করে নিজ গলে জয়ের মাল্য পরিধান করে আয়নায় নিজের পৌরুষদীপ্ত চেহারা দেখতে অভ্যস্ত পুরুষ। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও সেই ট্যাবু থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি পুরুষ। ‘পৌরুষ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ এবং এর ব্যাপকতা সম্পর্কে অজ্ঞতার জালে পুরুষ নিজেই আজ বন্দি।

সমতার মূল্যায়ণ, বৈষম্যের দেয়াল ভাঙ্গন , নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, নারীকে জাগিয়ে তোলা ইত্যাদিও যে পুরুষের গুণ, যা কিনা তার পৌরুষত্ব প্রকাশের অন্যতম হাতিয়ার সেই দীক্ষা প্রয়োজন আজ পুরুষের।

নারী দিবস চলমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক উদ্যোগ । নারীকে সক্ষম করে গড়ে তুলতে পারা উন্নত দেশগুলোও আজ এ লড়াইয়ে সামিল। নারীর সমতা, নারীর মর্যাদা,নারীর অবদানের স্বীকৃতির লড়াইয়ে লড়ছে বিশ্ব। এ লড়াই কেবল পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, এ লড়াই মানসিকতার বিরুদ্ধে। এই লড়াইয়ে সামিল নারী পুরুষ উভয়ই ।

এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য, “ডিজিটাল বিশ্ব হোক সবার: নারীর অধিকার সুরক্ষায় ও সহিংসতা মোকাবেলায় চাই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন বৈষম্যহীন সৃজনশীল প্রযুক্তি।”

প্রতিপাদ্যে নারীর প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে একবিংশ শতাব্দীতে এসে নারী তার ন্যায্য অধিকার আন্দোলনে সচেষ্ট, সেখানে তার প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান তাকে দুর্বল প্রমাণ করার এক দুরভিসন্ধি প্রয়াস।

ডিজিটাল প্রযুক্তি ব‌্যবহার, সৃজনশীল কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন সর্বক্ষেত্রে নারী আজ এগিয়ে। নিজ দক্ষতা বলেই তা সে অর্জন করেছে। এখানে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো স্থান নেই। নারী চায় তার কাজের স্বীকৃতি, নারী চায় তার সমতায়ন। নারী দিবসের প্রাক্কালে এ ধরনের শ্লোগান নারীকে অবমূল্যায়ন , তাকে হেয় প্রতিপন্ন, সর্বোপরি তার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের সামিল।

আজকাল শুধু শহরাঞ্চলে নয়, গ্রামাঞ্চলেও নারীরা বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। তৈরি হয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা। ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের কাজকে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্ববাজারে। নারীরা নিজ যোগ্যতায় ক্রিকেটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এতকিছুর পরেও যখন নারীর কাজকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ‘মানবিক’ শব্দটিকে জুড়ে দেয়া হয় তখন তার উদ্দেশ্য স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়।

নারী তার যোগ্যতা বলেই টিকে থাকতে চায়, কারো মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। নারীর দক্ষতাকে দুর্বল প্রমাণ করার প্রয়াস মূলত রাষ্ট্র ব্যবস্থার উন্নয়নের ভীতকেই দুর্বল করে দেয়। রাষ্ট্রকে বিষয়গুলোর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। কথায় আছে, “দশচক্রে ভগবান ভূত”। দুষ্টু চক্রের সম্মিলিত প্রয়াস অনেকসময় রাষ্ট্রকেও বিভ্রান্ত করে। ফলে মূল লক্ষ্য হয় বিচ্যুত । যে কোনো সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা ধুলিসাৎ করার জন্য অপশক্তি সর্বদা তৎপর থাকে। বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে এরা নিজেদের কার্য হাসিল করে। নারীর কর্মে, নারীর চরিত্রে , নারীর আদর্শে আঘাত হেনে তাকে অবদমিত করার অপকৌশল রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভীতকে দুর্বল প্রতীয়মান করে। রার্ষ্ট্রকে এ বিষয়গুলোর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

নারীর মর্যাদাহানি করে, নারীর অবদানকে অস্বীকার করে কোনো রাষ্ট্র কখনো এগিয়ে যেতে পারে না। তাই উন্নত দেশগুলো আজ নারীর অবদানকে হ্যাশট্যাগ দিয়ে লিখে সংগ্রহ করছে। একসময় এগুলো ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবে। নারীর সমতায়ন, নারীর অধিকার সম্বন্ধেও প্রত্যেকের সম্যক ধারনা থাকা প্রয়োজন। নারীর অবদানের স্বীকৃতি মানে তার স্পিরিট, তার শক্তিকে জাগিয়ে তোলা। যে ইতিহাস নারীর অবদানকে উপেক্ষা করে রচিত হয়েছে তা অসম্পূর্ণ, অসমাপ্ত।

কাজেই নারীর ‘স্পিরিট’বা আত্মার শক্তির পবিত্রতা নষ্ট করার অধিকার কারোরই নেই না ব্যক্তির,না সমাজের, না রাষ্ট্রের। যদি তা করা হয়, তবে সেটি পাপ মহাপাপ।।

আর এই মহা পাপের দায়ভার হবে আপনার। এখান থেকেই নারীদের ন্যায্য অধিকার দিতে শিখুন। নারীদের কে সম্মান করতে শিখুন। নারীর অর্জনকে তাকেই ভোগ করতে দিন। তার অর্জন করা সম্পদের থেকে নিজেকে সন্তুষ্ট করা বন্ধ করুন। আপনার মানসিকতার পরিবর্তন করুন।  পুরুষতান্ত্রিকতার অবসান ঘটিয়ে সমতার প্রতিষ্ঠা করুন।